অপূর্ণতায় পূর্ণ - গল্প

অপূর্ণতায় পূর্ণ
রাতে যখন আমার স্ত্রী খাবার বেড়ে দিচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তেই হাতটি ধরে বললাম, "তোমাকে কিছু কথা বলবো।" তাৎক্ষণিক বসে পড়ল এবং খুব দ্রুততার সাথে খাবার খেয়ে যাচ্ছিলো সে।

আকস্মিকভাবে, কথাটা কিভাবে মুখফস্কে বের হলো আমি জানি না। "আমি ডিভোর্স চাই" কথাটা শোনার পর তার উত্তরে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক মৃদু স্বরে আমার স্ত্রী শুধু বলল, কেন?

তার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়াটাই তার রেগে যাওয়ার কারন হলো। সামনে যা পেলো ছুড়ে ফেলে দিচ্ছিলো এবং খুব চিৎকার করে বলেছিলো- "তুমি মানুষ না।" খুব অশ্রুসিক্ত অবস্থায় ছিলো। আমি জানি, সে হয়তো ভাবছে আমাদের বিয়েটা তাহলে কি ছিলো? আমাদের ভালোবাসাটাই বা কি ছিলো? সবকিছুর কষ্টকর উত্তর হলো- "তুমি আমার হৃদয় থেকে হারিয়ে গেছো, আমি তোমাকে কখনোই ভালবাসতে পারবো না, তোমার প্রতি আমার শুধু করুণা হয়"

একটা অপরাধবোধ নিয়েই তাকে ডিভোর্স পেপারটি দেখালাম। হাতে নেয়া মাত্রই টুকরো টুকরো করে ফেললো।

আমি বললাম- "যে মানুষটি তার জীবনের ১০ টি বছর শুধু আমার সঙ্গেই ছিলো তাকে প্রতিনিয়তই অপরিচিত মনে হয়। আমার অনুশোচনা হচ্ছে তোমার জীবনের সময় নষ্ট করার জন্য কিন্তু আমি তোমাকে তা কখনোই ফিরিয়ে দিতে পারবো না। আমি জেনিকে ভালোবেসে ফেলেছি এবং বাকি জীবনটা তার তার সাথেই থাকতে চাই।"

তার উচ্চৈ: স্বরে কান্না দেখে আমি কিছুটা সস্থির নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম। গত কয়েক সপ্তাহ এই ডিভোর্স এর ঘোড়ে ছিলাম। কিভাবে ব্যাপারটি নিয়ে শুরু করবো তার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলাম। সেই মুহূর্তে নিজেকে খুব হালকা লাগছিলো, এই ভেবে যে আজ আমি মুক্ত।

পরের দিন, বেশ রাত করে বাসায় ফিরলাম এবং আবিস্কার করলাম যে আমার স্ত্রীর কি যেন লিখছে। রাতের খাবার খাওয়া হইনি, আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম তাই সোজা ঘুমুতে চলে গিয়েছিলাম। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি সে তখনও লিখে চলছে।  আমি পাত্তা না দিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলাম।

সকাল বেলা সে দেখাচ্ছে তার ডিভোর্সের শর্তাবলীঃ

১. বিবাহ বিচ্ছেদ বাবদ সে কিছুই চায় না।
২. বিবাহ বিচ্ছেদের পূর্বে একটি মাস একসাথে থাকতে চায় (করণটা অবশ্য যুক্তিসঙ্গত, আমাদের একমাত্র সন্তান আদিত্য'র পরীক্ষা শুরু হচ্ছে) এবং সে চাচ্ছিলো না আমাদের ডিভোর্সের জন্য আদিত্য'র সমস্যা হোক।
৩. আগামী এক মাস আমাদের আচার-আচরণ খুব স্বাভাবিক থাকবে।

উক্ত শর্তাবলীগুলো আমার জন্য প্রীতিকর হলেও সে হয়তো আরও বিশেষ কিছু চাইতো। সে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল, আমাদের ফুলশয্যার রাতের স্মৃতি। তার একটা হাস্যকর অনুরোধও ছিলো- আগামী এক মাসের প্রতিটা দিন সকালে তাকে কোলে অর্থাৎ আমার দুই বাহুর উপর রেখে নিয়ে যেতে হবে, শোবার বিছানা থেকে বসবার ঘর পর্যন্ত। আমি ভাবছিলাম- পাগলী একটা। যাইহোক, কথা না বাড়িয়ে মেনে নিলাম, একটি মাসেরই তো বিড়ম্বনা।

সবকিছু শুনে জেনি খুব উচ্চস্বরে হেসে উঠলো এবং বলল, "কি আজগুবি ব্যাপার, তোমার স্ত্রী পারেও বটে।" আমার স্ত্রী ও আমি ডিভোর্সের ব্যাপারটি ভেবে সহবাস থেকে বিরত ছিলাম। তাই প্রথম যখন তাকে কোলে নিলাম, আমাদের আনাড়ি এবং খুব বেখাপ্পা লাগছিলো। পাশেই আদিত্য হাত তালি দিয়ে হেসে হেসে বলছে, "বাপু আম্মুকে কোলে নিয়েছে।" আদিত্যের প্রতিটা শব্দ আমাকে চরমভাবে আঘাত করতে থাকলো। শোবার ঘর থেকে বসার ঘরের দূরত্ব সর্বচ্চ ১০ (দশ) মিটার হবে হয়তো। ঠিক আমার বাহু দুটোর উপরে আমার স্ত্রী, চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে বলল, "আদিত্যকে আমাদের ডিভোর্সের কথা বোলো না।" আমি মাথাটা নেড়ে সম্মতি জানালাম। এবং আমি যথারীতি অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

দ্বিতীয় দিন, খুব সহজেই তাকে বাহুতে রেখে চলছিলাম। হঠাৎ তার চুলের সুগন্ধ আমায় মাতাল করে তোলে। সেদিন খুব উপলব্ধি করেছিলাম অনেক দিন ভালো করে দেখিনি আমার স্ত্রীকে। এও খেয়াল করলাম সে আগের মতো নেই, বয়সের ছাপ পরেছে। যেখানে তার মুখে টোলসহ হাসি দেখতে পেতাম, তার উদ্দামতায় আমায় মাতাল করে রাখতো।

চতুর্থ দিন যখন আমার স্ত্রীকে কোলে তুলে নিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম আমাদের আগের অন্তরঙ্গতা ফিরে এসেছে। আমি খুবি বিস্মিত হলাম এইভেবে যে, সেই ১০ বছর আগের একই অনুভূতি।

পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিন, আমি খুব ভালভাবেই খেয়াল করলাম আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। এটা খুব সহজ ছিলো যে, জেনিকে কিছুই জানালাম না। সম্ভবত, প্রতিদিন নতুন উদ্দামতায় আবিষ্ট করছিলো আমায়।

এক সকালে অ ড্রেস পরিধান করার সময় খুব রেগে যাচ্ছিলো। তার বিশাল কারন অবশ্য একটা ছিলো, সব ড্রেস গুলোই খুব বড় হয়ে গেছে। আসলে কাপর তো আর বড় হয়নি, মানুষটি শুকিয়ে পাতলা হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার স্ত্রী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। আমি দৌড়ে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, "কি হলো?" জবাবে বলল, "ব্যাথা করছে ভীষণ।" আদিত্য এসে হাত দেখিয়ে বলছে, বাপু আম্মুকে তুমি কোলে নিয়ে ওই ঘরে যাও। আমি আর দেরি না করে কাজটি সেরে ফেললাম। আমার মনে হচ্ছিলো আদিত্য এটা জীবনের অত্যাবশ্যক কাজ হিসেবে দেখছে। তাই হয়তো আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলো। আমার স্ত্রী আদিত্যকে কাছে আসতে বলল এবং বুকে জড়িয়ে নিলো।

যাইহোক, একমাস পূর্ণ হবার শেষ দিন যখন অফিসের উদ্দেশ্যে গাড়ীতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার চোখ জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেলো এবং আমার চিন্তা ধারায় আমূল পরিবর্তন আসলো। অফিসে পোঁছে জেনিকে বললাম, "আমি ডিভোর্স চাই না।" শুনে কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার কপালে হাত দিয়ে বলল, "তোমার কি জ্বর টর এসেছে নাকি?" আমি তার হাত সরিয়ে বললাম, "না আমি ডিভোর্স দিতে চাই না। আমাদের বৈবাহিক জীবন খুব বিরক্তকর ছিলো, কারণ আমারা দুই জনই এটার মূল্য বুঝতে পারিনি। এখন আমি অনুভব করছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিদিনের মতো তাকে কোলে.........।।"

জেনি খুব রাগান্বিত হয়ে আমার বাম গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেয়। আমি সোজা হয়ে দাড়াতেই আবিস্কার করলাম অশ্রুসিক্ত জেনির চলে যাওয়া।

বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে আমার স্ত্রীর জন্য ফুলের দোকান থেকে একটি ফুলের তোড়া নিয়ে নিলাম। গিফট কার্ডে লিখলাম, "মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে তোমায় কোলে নিতে চাই।"

যথারীতি বাসায়..... হাতে তোড়া, মুখে হাসি নিয়ে প্রবেশ করলাম। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমার স্ত্রীকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পেলাম।

আসলে আমার স্ত্রী ক্যানসার নামক মারাত্মক রোগে বেশ কয়েক মাস যাবত ভুগতেছিল, কিন্তু আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম জেনিকে নিয়ে। সে জানতো, সে খুব তাড়াতাড়িই চলে যাবে এবং সে চেয়েছিল আমাদের ডিভোর্সের জন্য আদিত্যর মনে কোন ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়। সবশেষে আমাদের সন্তানের চোখে আমি একজন আদর্শ স্বামী।
----------------------------------------------------------------------------------------
একটি সম্পর্কে শুধু মাত্র সুবৃহৎ অট্টালিকা, বাড়ি, গাড়ী, ব্যাংক-ব্যালেন্স এইসকলের মধ্যে আবদ্ধ নয়। উক্ত ঘটনা কিংবা কাল্পনিক গল্প যাই বলেন না কেন, একটু খেয়াল করে দেখবেন তাদের মধ্যে কিসের অভাব ছিলো? ভালোবাসার। ভালোবাসার বড়ই অভাব ছিলো। ছোট-খাটো অনেক ব্যাপার রয়েছে যা দিয়ে আপনি আপনার স্ত্রী অথবা স্বামীকে খুশী করতে পারেন, এতে আপনাদের মাঝে অন্তরঙ্গতাও বাড়বে। সুখবোধ করবেন। সুখী ও আনন্দময় জীবন কাটাতে পারবেন।
----------------------------------------------------------------------------------------

বিশেষ দ্রষ্টাব্যঃ উক্ত ঘটনা কিংবা গল্পের মূল লেখক আমি নই। ভিনদেশী একজন লেখকের লেখা কিন্তু তার নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনুবাদ বললে ভুল হবে, আমি আমার নিজের মতো করে লিখার চেষ্টা করেছি। সবশেষে ভিনদেশী লেখককে ধন্যবাদ।