একটি অপরিপক্ব ভ্রূণ অথবা রসায়ন


একটি অপরিপক্ব ভ্রূণ অথবা রসায়ন

মোঃ মেহেদী হাসান



সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম তুহিন
বিশেষ কৃতজ্ঞতা : আবু ফাহিম আবদুল্লাহ


প্রকাশনী : পাতা প্রকাশনী
প্রকাশক : মো. মেহেদী হাসান
প্রকাশিত সংখ্যা : ২৩ কপি



প্রকাশের তারিখঃ ২২ শে নভেম্বর, ২০১৩




বাংলদেশের সহজ সরল এক ছেলে সবুজ। গ্রামে জন্ম, সবুজেই সে মানুষ। সকলের আদুরে ছিল। পড়ালেখার তাগিদে চেনাজানা পরিবেশ ছেড়ে এসেছে ইটপাথর আর কালোধোয়ার শহর ঢাকাতে। আর এখানেই ধীরে ধীরে জানতে শিখেছে বাস্তবতা, চিনতে শিখেছে জীবনের রূপ। আবেগ আর বাস্তবতার মধ্য দিয়েই কেটে যাচ্ছে তার সময়, ভারী হচ্ছে অভিজ্ঞতার ঝুড়ি। ঠিক তেমনি, জীবনের দেয়া কোন শিক্ষার মুখোমুখি সে আজ?

সবুজের আত্মকথনের মধ্য দিয়েই ঘটনা এগিয়ে চলছে। অত্যন্ত সহজ, সরল, সাবলীল ভাষা এবং প্রাঞ্জল উপস্থপনার মাধ্যমে লেখক তুলে আনার প্রয়াস চালিয়েছেন গভীর জীবন দর্শন, আমাদের প্রতিদিনের জীবনের ছোট ছোট আবেগ-অনুভূতি। কিশোর মনের প্রেম, কিছু ভুল, অবচেতন মনের চিন্তাধারা সব কিছুই রয়েছে একটি অপরিপক্ব ভ্রূণ অথবা রসায়ননামক ছোটগল্পে।



তৌহিদুল ইসলাম তুহিন, সম্পাদক।





প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। ঘুম ঘুম চোখে বিছানার এদিক ওদিক খুঁজলাম। হুম, পাওয়া গেছে। খুঁজে পেয়েছি সেই যন্ত্রণাদায়ক প্রাণী'র দলকে। ছোট ছোট লাল পিঁপড়ার দল। সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বেশ জোরসে অভিযান চালিয়েছে আমার বিছানার চাদর জুড়ে। কিন্তু এদের এখানে কি কাজ? এদের সাথে কি আমার পূর্ব শত্রুতা ছিল! আমার জানা মতে এদের সাথে আমার কখনও শত্রুতা থাকতে পারে না। তবে আমাকে নিরীহ পেয়ে তাদের মনের তীব্র প্রতিশোধের নেশায় মেতে উঠেছে।

তিনদিন হল বেশ গলা ব্যথার সাথে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছি। খাওয়া-দাওয়ায় অরুচি। বিছানাতেই বসে বসে দুপুরে এক গ্লাসের অর্ধেক চিনি মিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে-ভিজিয়ে পাউরুটি  খেয়েছিলাম। আর আমার অপরাধ হল:- খেয়েছি যখন, তখন কেন সেই চিনি মিশ্রিত পানির দুই এক ফোঁটা জল বিছানায় পরল। এই অপরাধে সাজা পাচ্ছি এখন। না, আর সহ্য হল না। জ্বর নিয়েই বিছানা থেকে নেমে চাদর টা ঝেড়ে ফেললাম।

এরপর কিছুটা বিষণ্ণতা নিয়ে টেবিলে রাখা মোবাইলটা হাতে নিলাম। মোবাইলের পর্দায় চোখ পরতেই দেখি একী! অবাক করা কাণ্ড!  ১৭ টা মিস কল!

হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া আমার মোবাইল নাম্বার কেউ জানে না। আর যেখানে ২-৩ দিন পরও মোবাইলের শব্দ শুনতে পাই না সেখানে কেউ ১৭ বার স্মরণ করেছে! আমি কি এমন ব্যক্তি- যে আমাকে কেউ স্মরণ করবে? তবে কেউ স্মরণ করতেই পারে, তাতে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাইহোক একটু ভিন্ন স্বাদ পেলাম।

মোবাইলের মিসড কললিস্ট পরখ করেই চমকে উঠলাম। সাথী আপু! এত বার স্মরণ করেছিল! নিশ্চয় কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্যই। এদিকে জ্বরটাও থেমে থেমে যন্ত্রণা দিচ্ছে। চিন্তা করলাম, সাথী আপুকে একবার ফোন করা যেতে পারে। তবে সেটা এখন নয়। ফোন ধরেই যদি কোন কাজের নির্দেশ দেয়। তাহলে জ্বর-টরের ধার ধারবে না। তার কথা মাটিতে ফেলবার জো নেই। এমনভাবে বলবে, যেন আমার জন্মই হয়েছে তার ফরমায়েশ শুনবার জন্য কিংবা তার জন্ম হয়েছে আমার উপর আদেশ জারি করবার জন্য।
খুব জ্বালাত একটা সময়। অর্থাৎ যখন তাদের বাসায় থাকতাম। মাঝে মাঝে সাঁঝ-সকালে হুট করে ঘুমের মানুষকে ডেকে ডেকে ঘুমের ১২ টা থেকে ১ টা বাজিয়েই ছাড়বে। বাজার থেকে ডিম এনে দিতে হবে- এই কথাটাই এমন ভঙ্গিতে বলবে যেন বাজারে যাওয়া আর ফায়ার সার্ভিসে ফোন করায় সমান উত্তেজনা বিরাজ করে।

ভেবে পাই না, দুলাভাই কিভাবে এতো অত্যাচার সহ্য করে। বোধ হয় সবারই ধীরে ধীরে সহ্যের ক্ষমতা বেড়ে যায়। আমার মনে হয়, পৃথিবীটা ধৈর্যের পরীক্ষার কেন্দ্র। আমারা সবাই ধৈর্যের পরীক্ষার্থী। কিন্তু অধিকাংশই উত্তীর্ণ হতে পারে না। আর যারা পারে না, তাদের আজীবনই এই পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। আবার যারা পারে, তাদেরও মৃত্যু পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে হয়। এই পরীক্ষায় বিশেষ কোন নির্দেশনা নেই। একটি নির্দেশনা প্রযোজ্য তা হল- সকলকে বাধ্যতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। নেই কোন রেজিস্ট্রেশনের বা প্রবেশপত্রের ঝামেলা। পরীক্ষার ফি পর্যন্ত নেয়া হয় না। শুধুমাত্র পরীক্ষা দাও, ফলাফল নাও। আমি বোধহয় একবারও এই পরীক্ষায় পাশ করতে পারি নি। ব্যাপারটা আমার জন্য খুবই হতাশাজনক এবং দুঃখজনক। সময় সুযোগ হাতে আসলেই পরের পরীক্ষায় ভাল করার চেষ্টা করতে হবে।

প্রায় চার মাস হয়ে এলো সাথী আপুদের বাসা ছেড়েছি। এর মধ্যে দিন দুয়েক যাওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু থাকা হয় নি কখনও। নিকেতনে তাদের নিজস্ব বাসা। অনেক বিশাল ফ্ল্যাট, আর দামি দামি সব আসবাবপত্রে সাজানো-গোছানো। চারটে শোবার ঘর তার মধ্যে তিনটেতেই অ্যাটাচড বাথরুমের ব্যবস্থা রয়েছে। আর একটি, যেটা আকারে অন্যগুলোর তুলনায় ছোট এবং অ্যাটাচড বাথরুম নেই সেই রুমটাতেই প্রায় দুই বছর সময় অতিবাহিত করেছিলাম। অনেক ঘটনাবহুল সময়।

নতুন নতুন ঢাকাতে এসেছি। কতো রাত্র কান্নায় কাতর হয়ে আমার ঘুমাতে হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। নিজেকে কয়েদী ভাবতাম। কবে মুক্তি পাব। সেই কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নে এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে জন্ম, তারপর নাম রাখা হল সবুজ। সবুজ বলেই সবাই ডাকতো। পুরো গ্রাম সবুজে আচ্ছাদনে সজ্জিত। কয়েক গ্রাম জুড়ে কত শত গাছ-গাছালি নিজেদের রূপ, সৌন্দর্য ঢেলে দিয়ে আমায় মুগ্ধ করে রাখতো। সারাদিন বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি , খেলাধুলা, গাছ থেকে আম, কাঁঠাল, পেঁপে পেরে ভাগাভাগি করা। কোলাঘাট, হিন্দুদের প্রাচীন মন্দির, নাও-ডাঙ্গা জমিদার বাড়ী এই সকল জায়গাগুলো আমার খুব আপন ছিল। আর বিধৌত নদী! সে তো আমার প্রেমের সাগর। নদীর ধারে বালিতে গড়াগড়ি খেয়ে যখন বালুর সাথে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতাম, ঠিক তখনি দৌড়ে ঝাঁপ দিতাম বিধৌত নদীর বুকে। মুহূর্তেই আমার ভালোবাসার ক্ষুধা, তৃষ্ণা কিছুটা মলিন হতো। নদীর বুকে যৌবনের উচ্ছ্বাস, অদম্য, অফুরন্ত প্রেম রয়েছে। যার প্রেমে হাবুডুবু খেতাম আর সাঁতরাতাম। প্রতিদিন ছুটে যেতাম নদীর বুকে শুধুমাত্র ভালোবাসা পাবার লোভে। নদীও আমায় খুব উজাড় করে ভালোবাসা দিত। ভাণ্ডার তবু শেষ করতে পারিনি।

কুঠিবাড়ী মডার্ন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হবার সময় শুধুমাত্র "সবুজ" নাম নিবন্ধন বিড়ম্বনায় পরতে হয়েছিল আমার বাবা-মাকে। হেড মাস্টার ছিলেন লালচন্দ্র চক্রবর্তী। তিনি আমার ভাল নাম অর্থাৎ স্কুলের খাতায় নাম লিখলেন- "সালেকিন আহমেদ সবুজ" আমারও খুব পছন্দ হল নামটি। যেহেতু হেড স্যার আমার নামদাতা ছিলেন সেহেতু আমি তার নাম কখনও ডোবাতে চাইতাম না। স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতেন।

আমাদের "বিদ্যালয়টি মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। ফুলবাড়ি উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয়টির দু'পাশে সবুজের মাঠ, মাঠের পশ্চিম পাশে ধরলা নদী। বিদ্যালয় ঘরটি দক্ষিণ মুখী। সামনে বিরাট খেলার মাঠ। ঘরের সাথে দুটি ফুলের বাগান। ০.৬৪ একর জমির উত্তর প্রান্তে দ্বিতল ভবন এবং একটি আধপাকা ঘর। দ্বিতল ভবনটির দৈর্ঘ্য ৮০ ফিট ও প্রস্থ ১৮ ফিট। আধা পাকা ভবনটি দৈর্ঘ্য ৪৫ ফিট ও প্রস্থ ১৮ ফিট। দ্বিতল ভবনের কক্ষের সংখ্যা ০৮ টি ও আধপাকা ভবনের কক্ষ সংখ্যা ০২ টি।"
স্কুল সম্পর্কে এতো ভালভাবে মনে রাখার কারণ একটাই। অফিস রুমের সোজাসুজি মাঠের এক কোণার সাইন বোর্ড- বড় বড় অক্ষরে লেখা। মাঠে খেলার সময় অথবা ক্লাস শুরু হবার আগে যখন সমাবেশ করানো হতো আমার চোখ পরে থাকতো সেই সাইনবোর্ডে।

স্কুল পেড়িয়ে যখন কলেজে পা দিব, তখন বাবা-মার ইচ্ছে ঢাকার কোন কলেজে ভর্তি হওয়া। আমি জানতাম এতে তাদের খরচ বেড়ে যাবে। টেনেটুনে চলে আমার বাবা-মার সংসার। তার উপর আমার ছোট এক ভাই আর এক বোন আছে। আমার বড় একজন ভাই ছিল তবে তিনি আমার জন্মের আগেই  ৭ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। অনেক করে বলেছিলাম ফুলবাড়ি ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হই। কে শুনে কার কথা। তারপর লালচন্দ্র স্যার যখন বললেন তখন আর মানা করতে পারিনি।

সেই থেকে আমি কারাবন্দী। আমার শৈশব, কৈশোর ফেলে আজ নির্বাসনে নির্জন ঘরে পরের অধীনে জীবনযাপন। দুনিয়া কতোটা নিষ্ঠুর! আমার ভালোবাসা কেঁড়ে নিলো! নদীর বুকে আর ক্ষুধা, তৃষ্ণা নিয়ে ঝাঁপ দেয়া হয় না। হয়তো নদীটিও আমায় ভুলে গেছে।




স্মৃতিপট থেকে নিজেকে বাস্তবতায় এনে যখন অনুভব করলাম জ্বর কিঞ্চিৎ দূর হচ্ছে, ভাবলাম কিছু খেয়ে নিলে মন্দ হয় না। সেই সাথে একটা নাপা এক্সট্রা খেয়ে নিলে আরও খানিকটা সেরে উঠবে। এদিকে হাতে টাকা-পয়সা খুব বেশি নেই। ঢাকার তেজকুনি পাড়ার এক ছাপরা মেসে থাকি। আমার সাথে আরও দুজন বিল্লাল ভাই আর রুস্তম চাচা। দুজনেই খুব ভালো মানুষ বটে। বিল্লাল ভাই একটি কমিউনিটি সেন্টারের বাবুর্চি পেশায় রয়েছেন। আর রুস্তম চাচা কারওয়ান  বাজারে কলার আড়তে কাজ করেন। আর আমি ঢাকা কলেজ থেকে এই বছরই এইচ এস সি পাশ করলাম। এর সাথে দুটো টিউশনি করি।

সাথী আপুদের বাসা ছেড়ে চলে আসবার সময় আগ মুহূর্তে বাসা খোঁজার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল আমাকে। এদিকে ইউনিভার্সিটি এডমিশনের জন্য ফার্মগেট শাখার ইউসিসি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই। যে করনে ফার্মগেটের আশে পাশেই বাসা নিতে হবে। আমার ক্লাস শুরু সময় ছিল সকাল আটটায়। তাই খুব সকালে চলে আসতাম। ক্লাস শেষ করেই বাসার খোঁজে নেমে পরতাম। তেজগাঁও, বেগুনবাড়ি, রাজাবাজারের প্রতিটা গলি তখন আমার চেনা হয়ে গিয়েছিল। সবই আমার সাধ্যের নাগালের বাইরে ছিল। প্রায় ছয়টা দিন আমার এইভাবেই কেটেছিল।

সপ্তম দিনের শেষ মুহূর্তে যখন সূর্যের আলো মিলিয়ে সন্ধ্যা হল। নিজের ক্লান্তি ও ক্ষুধা দূর করবার জন্য একটা টং দোকানে বসে টোস্ট বিস্কিট গরম চায়ে ডুবিয়ে খেতে লাগলাম। সেই মুহূর্তে বিল্লাল ভাইয়ের আগমন। তখনও জানতাম না তার সাথে একই রুমে আমায় বাস করতে হবে। আমার এখনও মনে পরে, বিল্লাল ভাই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে আমায় বলেছিল, ভাইজান একটু সইরা বসবেন? আমি মুখ থেকে টোস্ট বিস্কিট নামিয়ে একটু সরে বসলাম এবং তিনি আমার পাশে বসলেন।

বিল্লাল ভাই চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, কি করেন ভাই?
- এইতো পড়ালেখা করি।
- কই থাকেন?
- নিকেতনে।
- , এইখানে কই আইছেন?
- কোচিং এ ক্লাস ছিল। আপনি কোথায় থাকেন?
- আমি ভাই ছোট খাটো মানুষ, একটা মেসে থাকি। আর দীপা কমিউনিটি সেন্টারে বাবুর্চি গিরি করি।
- , আমি ভাই একটা মেস বাসা খুঁজছি। কিন্তু সবখানেই আমার জন্য ভাড়াটা বেশি হয়ে যায়।
- ক্যান? আপনে না নিকেতনে থাকেন?
- জি, আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসা। কিছু ঝামেলা হচ্ছে থাকতে।
- , বুঝছি। তা বাসা-টাসা পাইছেন?
- জি না ভাই। ইয়ে, মানে... আপনার পরিচিত আছে কোন......?
- , খাড়ান  একটু দেইখা লই।

তিনি চা শেষ করে দোকানে বসা ছেলেটাকে বলল, মিন্টু ১ টা শেইখ দেতো। সিগারেট ঠোঁটে চেপেই পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে খানিটা আড়ালে চলে গেল। এদিকে আমার ভয় ভয় করছিল। কি জানি কার পাল্লায় পরলাম! বিপদ-টিপদ হবে না তো? বিপদ আর কি হবে! পকেটে একটা পুরানো নোকিয়ার নড়বড়ে মোবাইল আর ৭০-৭২ টাকা।

কিছুক্ষণ পরে এসে বলল, হ ভাই হইয়া গ্যাসে। আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়ে গেছে ভাই? ক্যান আপনের না বাসা দরকার, তিনি উত্তর দিলেন।
- ভাই, ভাড়া কতো?
- আরে মিয়া ভাড়া নিয়া চিন্তা কইরেন না। আগে চলেন আমার লগে । তারপর দেখা যাইব।

মনের ভয় ক্রমেই বেড়ে উঠল। যা ভাবছি তাই যদি হয়! অনেকটা শঙ্কা আর দ্বিধা নিয়েই উনার সাথে চললাম। তবে তাকে দেখে ভালো মানুষই মনে হয়। মানুষকে পরোখ করে তার কাজের অনুমান করা অনেক কঠিন ব্যাপার। তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন-
- আপনের নাম কি?
- জ্বি, সবুজ।
- সবুজ! কি কন? আমার চাচাতো ভাইয়ের নামওতো সবুজ। সে থাকে বুড়িগঙ্গার ওইপাড়ে কদমতলিতে। মাঝে মইধ্যে আসে আমার কাছে।
- অহ, আপনার নাম কি ভাই?
- বিল্লাল।
- বিল্লাল নাকি? বেলাল?
- অই আর কি, বেলাল বিল্লাল একি তো।
- হুম। আমার স্কুলের এক বন্ধুর নাম বেলাল।

আমার কথা শুনেই অট্টহাসি ফুটল বিল্লাল ভাইয়ের মুখে। তখন চিন্তা করছিলাম একই দেশের কতশত মানুষ। সবাই তো ভিন্ন ভিন্ন। এই ভিন্নতার মাঝেও কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই যেমন এখন বিল্লাল ভাই আর আমার বন্ধু বেলালের নামটা। আবার আমার সাথে বিল্লাল ভাইয়ের চাচাতো ভাই।

গলির অন্ধকারময় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমি আর বিল্লাল ভাই। কিছু রিক্সা-ভ্যান চলছে। আর কিছু পথচারীও চলছে তাদের গন্তব্যে। বিল্লাল ভাই এক গেইটের সমানে এসে বলল দ্যাখেন আপনের পছন্দ হয় নাকি”? ঘরের দরজার তালা খুলে আলো জ্বালিয়ে দিলেন। ছোট্ট একটা রুম। তার মধ্যে দুইটা চৌকী পাতা আছে। এক পাশে একটি আনলা আর মেঝের এক কোণায় কয়টা হাড়ি-পাতিল, বাসনকোসন পরে আছে।

আমি বললাম, বিল্লাল ভাই, এখানে কি আপনি একাই থাকেন? জবাবে বললেন, না। এক চাচা থাকে। রুস্তম চাচা।

- , উনি কোথায়?
- চাচা বাইরে আছে। দ্যাখেন আপনে থাকতে কোন সমস্যা হইব না তো?
- আমার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু আপনাদের...
- আরে না, আমি চাচারে আগেই কইয়া নিছি।
- ও। তাহলে ভাড়া কতো দিতে হবে?
- আপনে ভাড়া নিয়া এতো চিন্তা করতাছেন ক্যান?
- না ভাই। তারপরও বলেন। আমার যদি না হয়...
- আপনার ভাড়া দিতে হবে না।
- কি বলেন! না ভাই। তা কি করে হয়?
- আচ্ছা যান! আপনে খালি কারেন্ট আর গ্যাসের বিলটা দিয়েন।
- তাও কতো দিতে হবে?
-সবকিছু মিলাইয়া পাঁচ', 'শ হয়। আচ্ছা আপনে পাঁচ'শ টেকা দিয়েন।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
- তাইলে কালকেই আইয়া পরেন। আমিতো কাজে যামু। সকালে চাচা থাকবো।

এইভাবেই ধীরে ধীরে তাদের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। রুস্তম চাচা খুব রসিক মানুষ। শরীরের গঠন বেঁটে হলেও খুব স্বাস্থ্যবান। এখন তার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। শুধু মাত্র গালের দাড়িগুলো পাক না ধরলে দিব্যি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের জোয়ান ছেলে বলে চালিয়ে দেয়া যেত। শুনেছি তিনি জোয়ান কালে গ্রামে লাঠি খেলায় বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন। তার স্ত্রী ও সন্তানেরা টাঙ্গাইলের মধুপুর থাকেন। প্রতি মাসে একবার বাড়ি যান। তিন-চার দিন থেকে আসেন। আমাকে অবশ্য একবার নিয়ে যাবে বলেছিল। তার মুখে মধুপুরের অপূর্ব বর্ণনা শুনে শুনে আমারও খুব যেতে ইচ্ছে করেছিল। আফসোস এই মাসে তো যাওয়া হল না, আমার জ্বরের কারণে। দেখা যাক সামনের মাসে হয়তো যাওয়া যেতে পারে।




আবারও স্মৃতিপট থেকে নিজেকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনলাম। এর মধ্যে আমার জ্বরে কাবু হওয়া দেহখানি অনেকটুকুই সবল হয়েছে। ফোনটা হাতে নিয়েই সাথী আপুকে ফোন দিলাম। দুবার ফোন দিয়েও ওপাশ থেকে কোন সাড়া নেই। ভাবলাম হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত। দুই থেকে তিন মিনিট পর সাথী আপুর ফোন নাম্বর আমার মোবাইলের পর্দায় ভেসে উঠল। আর মেঘদল ব্যান্ডের "মুঠোফোন" গানটি বেজে উঠল। "হ্যালোজেন রোদ চিলতে বারান্দায়, টিকটিকি বলছে ভবিষ্যৎ......"

ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে আপু বলে উঠল, “অ্যায় তুই কোথায় আছিস? সবুজএইতো বাসায় আছি আপু। তুমি কেমন আছো? জবাবে আমি বললাম।
- ভালো নাইরে ভাই।
- কেন?
- আছে। অনেক কথা আছে। তুই কালকে আমার বাসায় আসবি।
- অ্যা... কালকেই?
- হ্যাঁ, কালকে সকাল সকাল চলে আসবি।
- আচ্ছা ঠিক আছে।

ফোন রেখে একটু হাওয়া খেতে বের হলাম বাসার বাহিরে। রাত ৯ টা বাজে। এখন তো আমার রাতের খাবার খাওয়ার সময়। তবে হাওয়া খাওয়াও মন্দ হবে না। টানা তিন দিন হাওয়া খেতে পারিনি। মিন্টুর দোকানের চাও পান করা হয় নি। বের হয়ে সোজা মেইন রাস্তার উপরে ওভার ব্রিজে যাব।

ব্রিজের মাঝা মাঝিতে এসে রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছি। ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত মানুষগুলোর কথা ভাবছি। জীবনের তাগিদে সবার ছুটে চলা। কেউ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাস স্টপে দাড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে তার আশ্রয়ে ফিরবার জন্য। কারও হাতে রসকদমের মিষ্টির প্যাকেট, ছুটে চলেছে তার চাকরীর প্রথম মাসের উপার্জন নিয়ে। প্রিয় মানুষদের মিষ্টি মুখ করাবে বলে। সেলাই দিদি মনিদের হাতে টিফিন কেরিয়ার, শেষ হল তার আজকের কর্ম। দল বেঁধে খোশগল্পে চলছে তাদের অবিরাম পথ চলা। একজন আমাকে পাশ কাটিয়ে ছুটছে হাতে সরিষার তেলের বোতল নিয়ে। হয়তো বাসায় ফিরে বৌকে বলবে, আলু ভর্তা কর। খুব খিদে পেয়েছে। কারও পকেটে ক্যাটবেরি চকলেট খুব সযত্নে রয়েছে। বাড়ি ফিরে বলবে, মামনি এই নাও এটা তোমার....।

আঁধার বলে, ওহে মানব জাতি করোনা আমায় হেলা।
দিনের আলো পরবে যখন তোমার চিন্তায়,
বুঝবে তুমি, আমার কতো ঠেলা!
দিন বলে, ওহে নারী-পুরুষ নষ্ট বলে দিও না আমায় ধিক্কার।
আঁধার রাতে উষ্ণ হবে তোমার ওষ্ঠ,
বলবে তুমি, মাথায় হাত! এ নয় আমার অধিকার।

মাথায় কিছু শব্দ ঘুরপাক খেলছিল। সাথে সাথেই তা সাজিয়ে নিলাম। কাব্য নয় কবিতাও নয়। কি তাহলে? আমার মনের কথা অথবা সেই সব মানুষের চিন্তার ভাষা। এই সব কি মিলিয়ে যায়? নাকি মিলিয়ে দেই? সব শেষে - কি থাকে? পূর্ণতা? নাহ! শুধুই শুন্যতা!

আমাকে চিন্তা জগত থেকে ফিরিয়ে আনল এক ছোট্ট ছেলে। হঠাৎ আমার হাত ধরে বলে উঠল, “ভাই দুইডা টেকা দেন। বিস্কুট খামু।আমি কিছু না ভেবে বললাম, তাহলে চল আমার সাথে। ছেলেটি বলল, কই যামু? আমি মাথা নেরে বললাম, আয়, বিস্কুট খাইতে।

ব্রিজ থেকে নেমে মিন্টুর দোকানে গিয়ে থামলাম। মিন্টু দুই কাপ চা দে আর চারটা নোনতা বিস্কুট দে।
- ভাই আমি নোনতা বিস্কুট খাই না।
- তাইলে কি খাবি?
- মিষ্টি বিস্কুট।

আমি মিন্টুকে মিষ্টি বিস্কুট দিতে বলে বেঞ্চে বসে পরলাম। আর জিজ্ঞেস করলাম, “এই তোর নাম কি”? “আমার নাম সবুজ”, বলল ছেলেটি। এই শহরে কত-শত সবুজ আছে? চা-বিস্কুট খেয়ে সবুজের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সবুজ হাসি মুখে বিদায় নিয়ে চলে গেল তার গন্তব্যে, বস্তিতে।

বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে পরলাম। এদিকে বিল্লাল ভাই গেছেন বাড়ীতে। তার বড় চাচার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে। দুই দিন হয়ে এলো। কবে আসবে তাও জানি না। তাকে ফোন করেও পাচ্ছি না। আবার সকালে সাথী আপুর বাসায় যেতে হবে।




রাতে কি ভয়ংকর দুঃস্বপ্নই না দেখলাম। প্রকাণ্ড দেহের এক দৈত্য এসে হাজির। আমার সামনেই আমার পরিচিত মানুষদের তার হাতের মুঠোয় নিয়ে পিঠে বাঁধা এক থলের মধ্যে রাখছে। যেন বিধৌত নদী থেকে "কদু" জেলে তার জালে আটকে পরা মাছগুলোকে ধরে ধরে রাখছে। আমি সহ্য না করতে পেরে তার সামনে গিয়ে কিছু একটা করেছিলাম নাকি কিছুই করিনি তা মনে করতে পারছি না। আবার এও হতে পারে, আমি দৌড়ে নিজের জান বাঁচাতে আড়াল হয়ে গেলাম। এটাকে কি ধরনের দুঃস্বপ্ন বলা যায়? অসম্পূর্ণ অথবা ঝাপ্সা একটা দুঃস্বপ্ন।

সকালের সূর্যের আলো চোখে না পরতেই মনটা ভারী হয়ে এলো। মোবাইলে সময় দেখে নিলাম, সকাল সাড়ে সাতটা। হাত-মুখ ধুতে ধুতে ভাবলাম, সাথী আপুর বাসায় যাব। একটু ভালভাবে সেজে-গুজে যাওয়া দরকার। বাদামী রঙের টি-শার্টটাতে বেশ ময়লা জমে গেছে। সেটা তো গায়ে জড়ানো যাবে না। তাহলে সবুজ রঙের টি-শার্টটা পরতে হবে। যেটার সামনের পাশটায় বাংলাদেশের মানচিত্রের লাল জল ছাপ দেয়া।

দরজায় তালা ঝুলিয়ে বের হয়ে এলাম গলির মাথায়। মিন্টুর দোকানে যাওয়া দরকার। গতকাল রাতে মিন্টু বলেছিল তার শরীর খারাপ লাগছে। বায়ু পরিবর্তন কালে প্রায় সবারই কম-বেশি অবস্থা নাজুক হয়। এটাই প্রকৃতি ও মানবের মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় করে তুলে। দূর থেকেই বুঝতে বাকি রইল না। এই সেরেছে! বোধহয় বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। আমি আর দেরী না করে হাটা শুরু করে দিলাম। উদ্দেশ্য নিকেতন, সাথী আপুর বাসায়।

ফুটপাথের রাস্তা ধরে পায়ে হেটে চলেছি। আমার মন স্মৃতি খুঁজে বেড়ায় তখন বেশ কিছু দিন আগের জমাট বাঁধা অনুভূতির বাঁধন খুলতে থাকল।  আজ যদি সময় সুযোগ হয় তাহলে সেই নাম না জানা মেয়েটিকে এক নজর দেখে নেয়া যেতে পারে।

শ্যামা রঙের মেয়েটি যার প্রতিটা বিকেল কাটে বারান্দায় বসে বসে। শুধু বসেই থাকে না। মাঝে মাঝে নৃত্য চর্চাও করে। আবার কখনও কখনও হাতে বই নিয়ে দৃষ্টির সীমানা লঙ্ঘন করে সৃষ্টির দিগন্তে হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় হয়তো রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি লাবণ্যের মাঝে। অমিত যখন লাবণ্যের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে কলকাতা যাবার উদ্দেশে। আবার কবে হবে তাদের দেখা? হয়তো লাবণ্যের মতোই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে যেতাম। মাঝে মাঝে চোখে চোখ পরলে থেকে থেকে মুখে হাসি ফুটবে আবার বিরুক্তিভাব এনে অন্য কাজে মনোযোগ দিবে। আর আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা থেকে ফিরে আসতাম। অতঃপর রবি ঠাকুরের সংগীত আমার মনকে খোঁচা দিয়ে জেত।

অনেক কথা যাও যে ব'লে কোনো কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।
যে আছে মম গভীর প্রাণে ভেদিবে তারে হাসির বাণে,
চকিতে চাহ মুখের পানে তুমি যে কুতূহলী।
তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি।
আমার চোখে যে চাওয়াখানি ধোওয়া সে আঁখিলোরে-
তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি না পাও মোরে।
তোমার মনে কুয়াশা আছে, আপনি ঢাকা আপন-কাছে-
নিজের অগোচরেই পাছে আমারে যাও ছলি
তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি।

তবে আমার খুব ভালই লাগত এই ভেবে যে মেয়েটিও আমার মতোই কারাবন্ধী। তবে তার অবস্থা আমার থেকে ভিন্ন। কারাবাসের সময়গুলো খুব ভালভাবে কাটাতে শিখেছে সে। কিন্তু আমি তখনও শিখতে পারি নি। আচ্ছা এখনও কি তার বিকেলটা আগের মতোই কাটে? মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করতো কথা বলতে। কিন্তু সেই ইচ্ছে পর্যন্তই। কিভাবে সম্ভব, তা ভেবেও দেখি নি। হয়তো তার বিরক্তিমাখা মুখখানি আমার ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেয় নি। কি নির্মম! আমার ইচ্ছের মরণ সেইখানেই।

সাথী আপু আর মিরাজ ভাইয়ের প্রেম কাহিনী মনে পরে গেল। ভার্সিটির প্রথম দিকেই তাদের পরিচয়। সাথী আপু খুলনা ভার্সিটির ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে। মিরাজ ভাই খুলনা মেডিক্যালে পড়তেন। দুজনের মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের জন্মদিনে তাদের পরিচয়। সেই থেকে তাদের দুজনার মনের ভিতরে ভালোবাসার বীজ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তাদের প্রেম বিয়েতে গিয়ে ঠেকে। বেশ কিছু ঝামেলাও ছিল বিয়ে নিয়ে। তবে দুজনে তা সামাল দিতে পেরেছিলেন। সাথী আপুর বিয়ে নিয়ে যখন চাচা-চাচি খুব উঠেপড়ে লেগেছিল, তখন তাদের বাধ্য হয়ে পড়ালেখার এক বছর বাকি থাকতেই বিয়ে করে ফেলেন। তাদের বিয়ের বয়স আসছে ডিসেম্বরে প্রায় বছর পাঁচ গড়াবে।

এদিকে মিরাজ ভাই স্কয়ার ফার্মাতে মেডিক্যাল রিসার্চার হিসাবে কর্মরত আছে। অন্যদিকে সাথী আপু স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে কর্মরত ছিল। এখন অবশ্য চাকরী ছেড়ে বাসায় থাকে। সাথী আপুর একটা অভিযোগ প্রায় লক্ষ্য করতাম, তিনি ভাইয়াকে বলত, “তুমি আমারে আগের মত ভালোবাসো নাভাইয়া তখন বুঝাতে চেষ্টা করে, আসলে তেমন নয়। কিন্তু বুঝিয়ে কোন লাভ হত না।

তাদের মধ্যে অনেক ঝগড়া হত। এটাকে ভালবাসার ঝগড়া বলে বোধ হয়। তাই হবে, কারণ- একটি ভালবাসায় দুজন মানুষের সুখ-দুঃখ, অভিমান, প্রেম, ঝগড়া সবই থাকতে হবে। তবেই না ভালবাসা পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু আমি চলে আসার আগে আগে মিরাজ ভাইয়ের আচরণ অনেকটাই বদলে যেতে দেখেছি। তিনি প্রায় অস্থিরতায় ভুগতেন। আমার সাথেও খুব খারাপ আচরণ করা শুরু করল। আমি আসলেই জানতে পারি নি, আমার কোন অপরাধ ছিল কি না। খুব খারাপ লাগত, যখন আমার কারণে আপুর সাথে ঝগড়া হত। তার আচরণ যে শুধু আমার উপর পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। তার প্রতিটা কাজে অসহিষ্ণুতা চলে এসেছে। সহ্য ক্ষমতা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে, সেই সাথে তাদের ভালবাসা। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আজও উদ্ধার করতে পারিনি।

আমি চলে আসার পর তাদের অবস্থা কি তা আর জানতে চাইনি। এখনও কি তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়? নাকি সব আগের মতো মধুর ঝগড়ায় পরিবর্তন হয়েছে?

এদিকে সময় দেখতে মোবাইল পকেট থেকে বের করলাম। ১১ বাজতে ৪ মিনিট বাকি। এরই মধ্যে আপু দুবার কল করেছিল। থাক, এখন আর তাকে কল করে কাজ নেই। একেবারে দরজার ডান পাশে কলিং বেলের সুইচ চেপে কল করব।

দরজা খুলে দিয়ে একটু অবাক হয়ে বলল, “কিরে এসেছিস! আয় ভিতরে আয়আমি কিছু না বলে ভিতরে ঢুকে পরলাম।




বিকেল সাড়ে চারটা বাজতে তিন মিনিট বাকী। সাথী আপুর বাসা থেকে নেমে সময়টা দেখে নিলাম। এদিকে মনের ঘরে যেন ঘূর্ণিঝড় সব উলটপালট করে দিচ্ছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস বোধ হয় আগেই পেয়েছিলাম। সকালের দুঃস্বপ্নটাই হবে। এ কেমন প্রকৃতি!
আসলে প্রকৃতি তার নিয়মানুযায়ী সবার প্রাপ্য দিয়ে যায়, কিন্তু আমারা কেউ নিতে শিখিনি। আর যখন নিতে শিখি তখন প্রকৃতি হাত গুটিয়ে নেয়। সমন্বয় কিংবা শেখার অভাবে আমাদের প্রাপ্য হারিয়ে যায়। কঠোর নিয়ম পালন করে এই প্রকৃতি!

ভাবতে খুব খারাপ লাগছে। সাথী আপু কখনও মাডাক শুনতে পারবে না। মিরাজ ভাই বাবাডাক শুনবে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন স্বর্গীয় ভালবাসা সর্বোচ্চ পর্যায় চলে যায় তখন সৃষ্টিকর্তা তাদের ভালবাসার উপহার হিসেবে সন্তান দান করেন। পৃথিবীর মধ্যে এই উপহার থেকে বড় কোন উপহার আছে বলে আমার জানা নেই। সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব দান যখন কোন মা-বাবার কোলে রয়, এর চেয়ে সুখময় ব্যাপার আর কি হয়?

ফুটপাথ ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরছি। বার বার সাথী আপুর কান্নার আওয়াজ আমার কানে বেজে যাচ্ছে। তার কান্না মাখা মুখখানি চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে। তার কান্নায় প্রকৃতি আজ অম্লান। প্রায় ছয় মাস আগে সাথী আপুর মেডিক্যাল রিপোর্ট এই ব্যাপারটা  ধরেছিল। কিন্তু সাথী আপু গত সপ্তাহে জেনে নিজেকে আর সামলে নিতে পারছে না। আর অন্যদিকে মিরাজ ভাই! ছয় মাস নিজের মধ্যে পুষে রেখে রেখে আজ পাগলপ্রায়। তিনি প্রায় রাতেই কিছু দুঃস্বপ্ন দেখে আসছেন।

তার দুঃস্বপ্নের প্রতিটি দৃশ্য তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। কখনও কখনও ছোট্ট শিশু এসে তাকে খুনি খুনিবলে চিৎকার করছে। আবার সেই শিশুটি তার সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাসছে। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, শিশুটির মুখের অবয়ব নাকি আমারই মতো। যার কারণে মিরাজ ভাই আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। যখন তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না, তখনি সাথী আপুকে জানাল। নিজেরাই আজ নিজেদেরকে খুনি ভাবতে শুরু করেছে।

কেন তারা খুনি হতে গেলেন? তারা কি পারত না সেই অনাগত সন্তানের ভরণপোষণ বহন করতে? ছোট্ট শিশু কতোটুকুই বা খেতে চাইত? তাদের বিয়ের এক বছরের মাথায় সাথী আপু অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। তিন মাস পেটের মধ্যে অনাগত শিশুটি কতই না স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু মিরাজ ভাইয়ের জোরাজুরিতে তাকে পৃথিবীর বুকে বিচরণ করতে দেয়া হয় নি। যার জন্ম হচ্ছিল এক ভয়াবহ মৃত্যুর অপেক্ষা নিয়ে।

সেই সন্তান কি তাদের দুজনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাঁধা দিত? কিন্তু তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাদের সন্তানকে খুন করেছে। আজ যখন তাদের সন্তান হবার সম্ভাবনা হারিয়েছে, তখন সেই মৃত সন্তানকে স্মরণ করে খুনি বাবা-মার পরিচয়ে নিজেদের আখ্যায়িত করছে।

আজ যদি সেই সন্তান পৃথিবীতে বেঁচে থাকত তাহলে কি তাদের খুনের দায় নিতে হত? কখনই না। কোন এক সবুজ গ্রাম, হতে পারে কাশীপুর। কোলাঘাট, হিন্দুদের প্রাচীন মন্দির, নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ী এই সকল জায়গাগুলো তারও আপন হতে পারত। বিধৌত নদীর ধারে যেয়ে বালিতে গড়াগড়ি খেয়ে নদীর বুকে ঝাঁপ দিত। নতুবা সেই নাম না জানা মেয়েটির মতোই তারও বিকেল বারান্দায় কাটত। সেও হাতে বই নিয়ে দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে খুঁজে বেড়াতো।

আমি বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। রাত আটটা বাজতে এখনও পনের মিনিট বাকী। মাথায় অনেক কিছুই ঘুরাঘুরি করছে। বাসায় যেয়ে এগুলোকে  বেঁধে ফেলতে হবে। অনেক দিন কিছু লেখা হয় না। আমার ডাইরীতে ধুলো জমেছে।

আজ ধুলো সরিয়ে সাজাব, তার কথা। অনেক আশা নিয়ে যে এসেছিল পৃথিবীর কাছে। পৃথিবী ফিরিয়ে দিয়েছে, “একটি অপরিপক্ব ভ্রূণকে



-------সমাপ্ত------